চলে গেলেন মালি, রয়ে গেল বাগান - রমাকান্ত আচরেকরের সেরা ৫ ছাত্র
চলে গেলেন প্রখ্যাত ক্রিকেট কোচ রমাকান্ত আচরেকর। দেখে নেওয়া যাক তার সেরা ৫ ছাত্রকে।
সদ্য প্রয়াত ক্রিকেট কোচ রমাকান্ত আচরেকর কোচিং শুরু করেছিলেন সেই ১৯৬৪ সালে। লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় ক্রিকেটকে তার ভবিষ্য়তের নায়কদের উপহার দেওয়া। তারপর থেকে একের পর এক বড় ক্রিকেটার তুলে এনে তিনি পেয়েছিলেন দ্রোণাচার্য সম্মান। পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী খেতাবও। তাঁর প্রয়াণে ভারতীয় ক্রিকেটের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।
আচরেকরকে সারা বিশ্ব চেনে কিংবদন্তি ক্রিকেটার সচিন তেন্ডুলকারের শৈশবের কোচ হিসেবে। নিঃসন্দেহে তাঁর বাগানের সেরা ফুল সচিন। কিন্তু, একা সচিনই নন, তাঁর ক্রিকেটার তৈরি কারখানা থেকে ভারতীয় ক্রিকেট পেয়েছে বহু ক্রিকেটারকে। কথায় বলে একজন শিক্ষক স্মরণীয় হয়ে থাকেন তাঁর ছাত্রদের মধ্য দিয়ে।
'আচেকর স্য়ার'-এর ইহলোক ছেড়ে যাওয়ার দিনে মাইখেল বেঙ্গলি তাঁর সেরা পাঁচ ছাত্রের কীর্তিকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানালো তাঁকে।
বিনোদ কাম্বলি
কাম্বলির সম্পর্কে আচরেকর নিজেই জানিয়েছিলেন মনোভাবই কাম্বলির শত্রু। আগ্রাসী ব্য়াটিং আর রঙিন জীবনযাপনে অল্প দিনের মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেটের একেবারে সেন্টার স্টেজে পৌঁছে গিয়েছিলেন কাম্বলি। স্কুল ক্রিকেটে সচিনে সঙ্গে জুটি বেঁধে রেকর্ড ৬৬৪ রান তুলেই খবরের শিরোনামে পৌঁছেছিলেন কাম্বলি।
পর পর দুই টেস্টে দুটি দ্বিশতরান দিয়ে তিনি টেস্ট কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। তা পরের ইনিংসে করেন একটি শতরান। এক ইনিংস বাদ দিয়ে আবার সেঞ্চুরি করেছিলেন। সব মিলিয়ে প্রথম ৫ ইনিংসে ৪টি শতরান পেয়েছিলেন তিনি। একদিনের ক্রিকেটে অতটা সফল না হলেও ২টি শতরান করেছিলেন।
এই চমকপ্রদ উত্থানের কাহিনী বেশিদিন টেকেনি। পানাসক্তি, বিশৃঙ্খল জীবন যাপনের জেরে ধীরে ধীরে বিনোদ কাম্বলিকে ভারতীয় ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যান। যখন তাঁর স্কুল জীবনের বন্ধু ক্রিকেটের একের পর এক রেকর্ড ভেঙে এগিয়ে গিয়েছেন, তখন তিনি শেষ টেস্ট খেলেন ১৯৯৫ সালে। কাম্বলিই সম্ভবত, আচরেকরের জীবনের সবচেয়ে বড় আফশোষের কারণ।
বলবিন্দর সিং সান্ধু
খুব বেশিদিন খেলেননি সান্ধু। কিন্তু তার মধ্য়েই ভারতীয় ক্রিকেটকে বেশ কিছু গর্বের মুহূর্ত উপহার দিয়েছিলেন এই মিডিয়াম পেসার। তবে আচরেকর বরাবরই বলেছেন, সান্ধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেরাটা দিতে পারেননি। তবে তা সত্ত্বেও ভারতীয় ক্রিকেটে কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন তিনি। বর্তমান ভারতীয় দলেও টেল এন্ডারদের রান না পাওয়া সমস্য়া হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি কিন্তু ৯ নম্বরে নেমে ৭১, ৬৮ রানের ইনিংস খেলে দেখিয়েছিলেন।
তাঁর বলে বিশেষ গতি না থাকলেও বিষাক্ত ইনসুইং মেশাতে পারতেন খুব ভাল। তার সেরা প্রদর্শন দেখা গিয়েছিল ভারতের জেতা ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে। গর্ডন গ্রিনিচ একেবারে বোকা বনে গিয়েছিলেন বলবিন্দরের ইনসুইং-এ। সেই বিশ্বকাপে ব্রিটিশ আবহাওয়ায় দারুণ কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে ফাইনালে ১৮৩ রান তাড়া করতে গিয়ে শেষ উইকেটের জুটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ২২টি রান যোগ করেছিলেন।
সঞ্জয় বাঙ্গার
ভারতের বর্তমান দলের ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারও কিন্তু আচরেকরের কামাথ মেমোরিয়াল ক্রিকেট ক্লাবের ফসল। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি অত্যন্ত বড় নাম ছিলেন। রেলওয়েজের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে উত্থান হয় তাঁর। কখনই প্রচারের আলোয় থাকতে পছন্দ করেননি। কিন্তু ২০০২ সালে রেলওয়েজকে তিনি রঞ্জি চ্য়াম্পিয়নও করেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটের সাফল্য খুলে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দরজা। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে তিনি নাগপুর টেস্টে শতরান করেন। এরপর তাঁকে অতিরিক্ত বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই ইংল্যান্ড সফরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে কিন্তু তিনি ব্য়াট হাতেই বেশি সফল হন। এমনকী ভারতের স্মরণীয় হেডিংলে টেস্ট জয়েও তাঁর বড় অবদান ছিল। ব্য়াট হাতে করেছিলেন ৬৮, আর বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন ২টি উইকেট। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তাঁর কেরিয়ার।
অজিত আগরকার
আগরকারের উত্থান হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন ভারতীয় জোরে বোলারদের হাতে হয় গতি থাকত, নয়ত সুইং। আগরকারের হাতে দুটোই ছিল। তাঁকে দেখেই আচরেকর বলে দিয়েছিলেন, অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ছোটখাট চেহারাতেও হাতে পেস, সুইং দুইই ছিল, আর উপরি ছিল রিভার্স সুইং। সেই সঙ্গে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটের হাতও মন্দ ছিল না।
১৯৯৮ সালে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেকের পর তিনি সবচেয়ে দ্রুত ৫০ উইকেট নেওয়া বোলার হয়েছিলেন। শতরান না পেলেও তাঁর সর্বোচ্চ স্কোর ৯৫। জিন্বাোয়ের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে ২১ বলে ঝোড়ো ৫০ রানও করেছিলেন। ওয়ানডে কেরিয়ার তিনি শেষ করেছিলেন ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হিসেবে।
টেস্টেও তিনি সমান কার্যকর ছিলেন। সেরা পারফরম্যান্স এসেছিল ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায়। অ্যাডিলেডে ভারতের টেস্ট জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ৪১ রানে ৬ উইকেট নেন। তবে অস্ট্রেলিয়াতে টেস্টে পর পর ৭ ইনিংসে শূন্য করার খারাপ রেকর্ডও রয়েছে তাঁর রে অবশ্য লর্ডসের মাঠে শতরানও করেছিলেন।
সচিন তেন্ডুলকার
আচরেকর স্যারের সেরা ছাত্র সম্পর্কে যত কথা বলা হয়, ততই ভাষা কম পড়ে। ক্রিকেটের হেন ব্যাটিং রেকর্ড নেই যা তিনি ভাঙেননি। এমন এমন রেকর্ড গড়েছেন, যা কখনও কেউ কল্পনাই করেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর মোট রান ৩৪৩৫৭, শতরান ১০০টি, অর্শতরান ১৬৪টি। ৭ টি বছরে ভিন্ন বছরের টেস্টে ১০০০ এর বেশি রান করার রেকর্ড তাঁর দখলে। একদিনের ক্রিকেটে সবার আগে পৌঁছান ১০০০০ রানের মাইলস্টোনে।
কিন্তু সে যত বড়ই ক্রিকেটার হোন, শিক্ষকের চোখে ছাত্র তো ছাত্রই থাকে। আচরেকও সবসময় বলতেন সচিন আরও ভাল খেলতে পারতেন। আর সচিনের মুখেও নিয়মিত ঝড়ে পড়েছে তাঁর 'আচরেকর স্যার'-এর প্রতি শ্রদ্ধা।
এই পাঁচজন ছাড়াও তাঁর বিখ্যাত ছাত্রদের তালিকায় আছেন প্রবীন আমরে, রমেশ পাওয়ার, সমীর দিঘে, অমল মুজুমদার, অতুল প্রমুখ।