বিসিসিআই সভাপতি হিসেবে কতখানি সফল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, দেখে নেওয়া যাক সেই হিসেব
বিসিসিআই সভাপতি হিসেবে কতখানি সফল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, দেখে নেওয়া যাক পরিসংখ্যান
সালটা ২০০০। ম্যাচ ফিক্সিং, দুর্নীতিতে জর্জরিত ভারতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্ব যখন তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, তখন অনেকেই মুখ বেঁকিয়েছিলেন। ভাবটা এমন যেন নতুন বলির পাঁঠা পেয়েছে দেশ। চোখা চোখা বিশ্লেষণের মধ্যে ওই বাঙালি তরুণ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, ভরসা করেছিল ভারত। হাত ধরে ভারতীয় ক্রিকেটকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনা শুধু নয়, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার হিম্মত সতীর্থদের মনে আমদানি করিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
এহেন ব্যক্তির হাতে বিসিসিআই-র সর্বেসর্বার মুকুট উঠতেই ফের নড়েচড়ে বসেছে গোটা দেশ। প্রায় সাড়ে তিন মাসে ভারতীয় ক্রিকেটকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, তা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
অক্টোবরে সিংহাসনে
গত ২৩ অক্টোবর বিসিসিআই-র সভাপতি নির্বাচিত হন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। দীর্ঘ টানাপোড়েন ও আলাপ-আলোচনার পর দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার শীর্ষ পদে মহারাজের আরোহনকে সানন্দে লুফে নেন দেশের ক্রিকেট প্রেমীরা।
গোলাপি বলের টেস্ট
প্রায় চার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় চালু হয়েছিল গোলাপি বলের দিন-রাতের টেস্ট। সেই সময় এই ফর্ম্যাটে তাদের দেশে টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছে আবেদন করেছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। তখন সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল বিসিসিআই। এমনকী নিজের দেশেও টেস্টের নতুন ফর্ম্যাট চালু করতে রাজি ছিল না দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা।
ব্যতিক্রম সৌরভ : বিসিসিআই অনড় মনোভাব দেখালেও স্রোতের উল্টোদিকে হেঁটে ২০১৬ সালে ইডেন গার্ডেন্সে সিএবি সুপার লিগ, গোলাপি বলের ফর্ম্যাটে করিয়ে তাক লাগিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তৎকালীন সিএবি সভাপতির দেখাদেখি সে বছর দেওধর ট্রফি দিন-রাতের ফর্ম্যাটে খেলিয়েছিল বিসিসিআই।
সভাপতি সৌরভ : বিসিসিআই-র সভাপতি পদে বসেই পরিবর্তনের ডাক দেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক দিন-রাতের টেস্ট সফলতার সঙ্গে আয়োজন করে দেখান মহারাজ। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই ম্যাচ কার্যত তিন দিনে শেষ হয়ে গেলেও, সৌরভের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায় বিশ্বের ক্রিকেট প্রেমীরা।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট
বিসিসিআই-র সভাপতির চেয়ারে বসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্য়ায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের সামগ্রিক মানোন্নয়নই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। সেই মতো দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের ভাতা বাড়িয়ে প্রতিশ্রুতির প্রথম ধাপ সাফল্যের সঙ্গেই পেরিয়েছেন বিসিসিআই সভাপতি তথা দেশের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক।
সিএসি সদস্য নিয়োগ
সুপ্রিম কোর্ট মনোনিত বিসিসিআই-র ক্রিকেট অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য থাকার সময় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সচিন তেন্ডুলকর ও ভিভিএস লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ ওঠে। বিতর্কের জেরে পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের তিন রথি। তাঁদের পর ওই আসনে বসা ভারতের ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক কপিল দেব, টিম ইন্ডিয়ার প্রাক্তন কোচ অংশুমান গায়েকোয়াড়ের বিরুদ্ধেও স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ ওঠে। তাঁরাও বিসিসিআই-র ক্রিকেট অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্যপদ ছেড়ে দেন।
সৌরভের বার্তা : বিসিসিআই-র সভাপতির চেয়ারে বসার পর স্বার্থের সংঘাত সংক্রান্ত নিয়মের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। এই নিয়মে দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটারদের ভারতীয় ক্রিকেটের উন্নয়নে তিনি কাজে লাগাতে পারবেন না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
নতুন সিএসি সদস্য : কপিল দেবরা সরে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন খালি অবস্থায় পড়ে থাকে ক্রিকেট অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্যপদ। বিসিসিআই-র সভাপতি পদে বসার তিন মাসের মধ্যেই নতুন সিএসি সদস্যের নাম ঘোষণা করেন মহারাজ। ভারতের ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ী দলের অন্যতম সদস্য মদনলাল, ২০০৭-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী টিম ইন্ডিয়াপ সদস্য আরপি সিং ও দেশের মহিলা ক্রিকেট দলের প্রাক্তন সদস্য সুলক্ষণা নায়েক নতুন সিএসি কর্তা নির্বাচিত হন। তাঁরাই ভারতীয় ক্রিকেট দলের নতুন প্রধান নির্বাচক বাছবেন বলে জানানো হয়েছে।
আইপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
বিসিসিআই-র সভাপতি পদে বসে সবার আগে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বন্ধ করেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত টাকা, দেশের ক্রিকেটারদের হিতার্থে কাজে লাগানো হবে বলে জানিয়ে দেন বিসিসিআই সভাপতি।
মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্ট মনোনিত প্রাক্তন বিচারপতি আর এম লোধা নেতৃত্বাধীন প্যানেলের তৈরি সংবিধান অনুযায়ী বিসিসিআই-র সভাপতি হওয়ার ১০ মাস পর সেই পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে। কারণ তাঁর আগে পাঁচ বছর তিনি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল বা সিএবি-র সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন। বিসিসিআই-র নতুন সংবিধান অনুযায়ী, এক ব্যক্তি ছয় বছরের বেশি দেশের ক্রিকেটের কোনও প্রশাসনিক পদ ধরে রাখতে পারবেন না কিংবা নতুন পদে বসতেও পারবেন না। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌরহিত্যে হওয়া বিসিসিআই বার্যিক সাধারণ সভায় সেই নিয়ম পরিবর্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিষয়টি এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
বুমরা-এনসিএ দ্বন্দ্ব
২০১৯-র ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে পিঠে চোট পান ভারতীয় ক্রিকেট দলের ফাস্ট বোলার জসপ্রীত বুমরা। চিকিৎসার জন্য তাঁকে লন্ডনে পাঠায় বিসিসিআই। সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পর ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ফিটনেস ট্রেনিং নেওয়ার কথা থাকলেও সে-মুখো হননি জসপ্রীত বুমরা। ব্যক্তিগত ট্রেনারের কাছে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। সেই অভিমানে বুমরার ফিটনেস পরীক্ষা নিতে অস্বীকার করে লেজেন্ড রাহুল দ্রাবিড় নেতৃত্বাধীন এনসিএ। সেই বিতর্কের নিষ্পত্তি ঘটান বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। অনুশীলন ম্যাচ খেলিয়ে বুমরাকে ফিটনেস পরীক্ষা পাস করান মহারাজ।
এনসিএ পরিকাঠামো
ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিই যে দেশের ক্রিকেটের পীঠস্থান, তা জানিয়ে দেন বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। দেশের কোনও ক্রিকেটার এই সংস্থাকে অবজ্ঞা করতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দেন মহারাজ। অন্যদিকে এনসিএ-র পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আমদানির লক্ষ্যে এক ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে গাটছড়া বাঁধে বিসিসিআই।