ভারতীয় ফুটবলে নক্কারজনক নজির, আইএসএল বনাম আই লিগ লড়াই রইল জারি
২০১৭ বিদায়ের পথে, দরজায় কড়া নাড়ছে আরও একটি নতুন বছর, ২০১৮। এই গোটা বছরে পাওয়া না পাওয়া অনেক কিছুই আছে।
২০১৭ বিদায়ের পথে, দরজায় কড়া নাড়ছে আরও একটি নতুন বছর, ২০১৮। এই গোটা বছরে পাওয়া না পাওয়া অনেক কিছুই আছে। তবে প্রাপ্তির ঝুলি ভরে উপচে গেছে অনেকক্ষেত্রে। এখন বছর শেষের পথে এসে ফিরে দেখা সেই অধ্যায়ের কয়েকটি পাতা।
দেশের প্রধান লিগ কোনটি
বহু বছর ধরে আই লিগ বলে যে লিগ চলে দেশে সেটা -র অস্তিত্বই ঘোর সংকটে। তিন-চার বছর আগে শুরু হওয়া আইএসএল -ই নাকি দেশের প্রধান লিগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ঘোর সংকটে ফুচবল মহল। সমস্ত ক্লাব থেকে শুরু করে সব প্লেয়ার -কোচ সকলেই ছুটছেন আইএসএলের দিকে। বছরের শুরুর এই চিত্রটা বছর শেষেও সকলেরই মনে আছি।
জুন মাসে মেগা বৈঠক
জুন মাসে কুয়ালালামপুরে মেগা বৈঠক। এএফসি-র বৈঠকে হাজির সকলেই। আইএমজি-র কর্মকর্তারা। মোহন-ইস্টের প্রতিনিধিরা। হাজির এআইএফএফ-র কর্মকর্তারাও। সেখানেই জুটিতে লুটি মোহনবাগান -ইস্টবেঙ্গলের। সেই সময়ের মতো রুখে দেওয়া গিয়েছিল আইএসএলকে। ওয়ান ইন্ডিয়া ওয়ান লিগ- অদূর ভবিষ্যতে এটাই হবে ভারতীয় ফুটবলের ট্যাগ লাইন। শতাব্দী প্রাচীন ক্লাবদের ঐতিহ্য রক্ষায় কার্যকারী ভূমিকা নিয়েছিল এএফসি। এএফসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছ আইএসএল এখন ঠিক যে ফর্মাটে রয়েছে তাকে কোনওভাবেই দেশের সর্বোচ্চ লিগের তকমা দেওয়া সম্ভব নয়।
তিনটে লিগের রফাসূত্র
এক নয় দুই নয়, এবার আবার তিনটে লিগ। এমনটাই নাকি ফেডারেশনের দেওয়া রফাসূত্র। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের মত দলগুলি ঠিক কীভাবে আইএসএলে খেলবে তা নিয়ে কোনও সমাধানসূত্র বের করতে পারা যায়নি। সেদিনের দিল্লিতে ফুটবল হাউসে ম্যারাথন বৈঠকে হাজির ছিলেন এআইএফএফ-র পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল প্যাটেল এছাড়াও ছিলেন সুনন্দ ধর,সুব্রত দত্ত। উপস্থিত ছিলেন আইএফএ সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায়। এছাড়াও ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, শিলং লাজং, চার্চিলের প্রতিনিধিরাও হাজির ছিলেন। একইসঙ্গে চলবে আইএসএল ও আই লিগ। আইএসএলের সেরা চার বা পাঁচ দল পাবে সুপার লিগের যোগ্যতা। ঠিক একইরকমভাবে আই লিগের সেরা চার বা পাঁচ দলও সুযোগ পাবে এই সুপার লিগে খেলার। সুপার লিগের খেলাগুলি হবে হোম ও অ্যাওয়ে ভিত্তিতে। এই সুপার লিগে যে চ্যাম্পিয়ন হবে সেই দল পাবে এএফসি-র চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। অন্যদিকে রানার্স আপ দল খেলবে এএফসি কাপে।
চিঠির অপেক্ষায় আইএফএ
দেশে হবে তিনটি ফুটবল লিগ এই ভাবনার মৌখিক জন্মের পর এআইএফএফ কথা দিয়েছিল দু একদিনের মধ্যে চিঠি পাঠিয়ে আইএফকে সরকারিভাবে বিষয়টি জানানো হবে। সে চিঠি আর এল না। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও অপেক্ষায় ছিল আইএফএ, অপেক্ষায় ছিল মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তারা। তবে এটুকু শুধু হিমশৈলের ওপর। এর তলায় রয়েছে চক্রান্তের পর চক্রান্ত। সোজা কথায় নতুন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের হোম-অ্যাওয়ে ম্যাচে আদৌ আগ্রহ নেই আইএমজিআরের। তারা চায় সরাসরি এএফসি-র ছাড়পত্র। আর তাই ফের কাঠি নাড়া হয়ে গেছে। আই লিগ হক বা আইএসএল এদের সম্পর্কে ফেডারেশন কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তা এফএসডিএল কে দিয়ে পাস করাতে হয়। আর সেখানে আইএমজিআর প্রতিনিধিদের হাঁকডাক বেশি। ফলে ফের আটকে গিয়েছিল তিনটি লিগের কনসেপ্টও।
এক মরশুমের জন্য সমাধান সূত্র
আইসিএলকে স্বীকৃতি দিয়ে দিল এএফসি। এএফসি-র সাধারণ সচিব উইন্ডসর এআইএফএফ কে সাময়িক সমাধান সূত্র বের করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এআইএফএফ তাতেও ব্যর্থ। এআইএফএফের প্রাথমিক প্রস্তাব ছিল আই লিগ , আইএসএল ছাড়াও হবে সুপার লিগ। জুনের ২৮ তারিখের বৈঠকে আইএসএল কে স্বীকৃতি দেওয়া এএফসি-র চিঠি এসে পৌঁছয় দিল্লিতে ফেডারেশনের সদর দফতরে। এর ফলে সামনের বছর এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলবে আই লিগ জয়ী দল। অন্যদিকে আইএসএল জয়ী দল খেলবে এএফসি কাপে। তবে এএফসি -র এই সমাধান সূত্র মাত্র এক মরশুমের জন্য। ফের একবার তারা জানিয়ে দেয় ২০১৭-১৮-র পর থেকে ভারতীয় ফুটবলে একটিই লিগ থাকবে।
সমস্যায় মোহন- ইস্টের মত দলগুলি
এই ধরণের ঘোষণার পর চাপে মোহনবাগান -ইস্টবেঙ্গলের মত দলগুলি কার্যত চাপে। আইএসএলে প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি তাই ফুটবলাররা ওই দলগুলিতেই খেলতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। কার্যত দ্বিতীয় সারির ফুটবলারদের নিয়ে দল সাজাতে বাধ্য হলেন আই লিগের দলগুলি।
কাদের সঙ্গে কথা মোহনবাগানের
আইপিএলে কলকাতার ফ্রাঞ্চাইজি কলকাতা নাইট রাইডার্সের সঙ্গে কথা চালিয়েছিল মোহনবাগান। মোহন বাগান কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও হয় কেকেআর সিইও ভেঙ্কি মাইসোরের। কথা অনেক দূর এগোনোর পর মউয়ের খসড়া তৈরি করেন বাগান আইনজীবীরা। কিন্তু সেই খসড়াতে ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেনি কোনও পক্ষই। এরপর নাকি এআইএফএফ আসরে নেমেছিল মোহনবাগানের তরী পাড়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ফরাসি এক কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা এগোনোর পর বাগান নাকি নির্দিষ্ট সময়ে কাগজ জমা দেয়নি। ফলে সেই কথাও কার্যকারী হয়নি। অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতার সঙ্গেও কথা চলার পর কোনও রূপরেখা পাওয়া যায়নি।
ইস্টবেঙ্গল কাদের সঙ্গে কথা
একই ঘটনা নাকি ঘটেছিল ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গেও । টাটা স্টিলের সঙ্গে নাকি কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল লালহলুদের। টাটা স্টিল ভীষণভাবেই এই লিগে খেলতে চেয়েছিল, তাই লালহলুদের হাত ধরেই তারা মাঠে এসেছিল। ইস্টবেঙ্গল জার্সি , লোগো, ক্লাবের ম্যানেজমেন্ট নিয়ে দু'পক্ষ ঐক্যমতে পৌঁছতে না পারায় চুক্তি হয়নি। শেষে টাটা স্টিল নিজেরাই আইএসএল খেলার জন্য দরপত্র তোলে।
অনড় ইস্টবেঙ্গল -মোহনবাগান
সবুজমেরুণের পক্ষ থেকে সহ সচিব সৃঞ্জয় বসু জানিয়েছেন ফ্রাঞ্চাইজি ফি দিয়ে মোহনবাগান কখনই খেলবে না। আইএসএলে খেলার বিভিন্ন শর্তের মধ্যে অনেক কিছুতেই মোহনবাগান নমনীয় হয়েছিল। এমনকি কলকাতার বাইরে কিছু ম্যাচ খেলতেও তাঁরা রাজি ছিলেন, কিন্তু ফ্রাঞ্চাইজি ফি দেওয়ার শর্তে কখনই তাঁরা সহমত ছিলেন না। তবে সৃঞ্জয় বসুর বক্তব্য,'আলোচনাতে সবরকম জট খুলতে পারে, ভারতীয় ফুটবলের স্বার্থে তাই আলোচনা চলা উচিত। খুব তাড়াতাড়ি এই জট খুলে যাবে।' ফুটবল স্পোর্টস ডেভলপমেন্ট লিমিটেডের এইসব তথ্যকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল সচিব কল্যাণ মজুমদার। তাঁর বক্তব্য, 'যাঁরা এই ধরণের কথা বলেছেন তাঁরা স্বকল্পিতভাবনা জানিয়েছেন। এটা পুরোপুরি মিথ্যে এবং এক বা একাধিক ব্যক্তির মস্তিষ্ক প্রসূত।' এর পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন ভারতীয় ফুটবলে এআইএফএফের কোনও বক্তব্য আর বেঁচে নেই, পুরোটাই 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস , থুড়ি হার মাস্টার্স ভয়েস।'
শেষ অবধি হওয়া আপডেট
আগামী বছরেও অর্থাৎ ২০১৮-১৯ মরসুমেও হয়তো এক হচ্ছে না আইএসএল ও আই লিগ। ফলে আই লিগেই খেলতে হবে কলকাতার দুই প্রধানকে। দিন কয়েক আগেই ফেডারেশন সচিব কুশল দাস ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ১৮টি দলকে নিয়ে ভারতীয় ফুটবলে একটি লিগ আয়োজন করার চিন্তাভাবনা চলছে। তবে ১৮ দলকে নিয়ে গোটা ভারতে একটাই লিগ হতে পারে আরও এক বছর পরে অর্থাৎ ২০১৯-২০ মরসুম থেকে। কারণ, ওই মরসুম থেকে এক শহর এক দল-এর বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে আইএসএলের দশটি টিমের সঙ্গে আই লিগের আটটি দল স্থান পেতে পারে প্রস্তাবিত ওই নতুন লিগে। ফলে কলকাতা থেকে এটিকে-র পাশাপাশি থাকবে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলও। তাতে এটিকেকেও কলকাতা ছাড়তে হবে না, ছাড়তে হবে ইস্ট-মোহনকেও।
২০১৭-১৮ তে কী হবে জানা নেই
আসলে আইএসএলের দলগুলি যেমন নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড়, ঠিক সেরকমই অনড় ইস্ট-মোহনও। তাই বিভিন্ন আলোচনার পরও কোনও রফা সূত্র বেরোয়নি। তাই এ মরশুমে তো বটেই তার পরের মরশুমেও আইএসএলে খেলা হবে না মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের। সূত্রের খবর, ভারতীয় ফুটবল নিয়ে সঠিক রূপরেখা ঠিক করতে গিয়ে বহু প্রস্তাবের মধ্যে এই প্রস্তাবই অগ্রাধিকার পাচ্ছে এএফসি-র কাছে। যা কানে এসেছে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন কর্তাদেরও। তবে এই প্রস্তাবে এখনও সিলমোহর পড়েনি। আলাপ-আলোচনা চলছে।