আইলিগ থেকে আইএসএল, ভারতীয় ফুটবল এক কদম এগোল কি
পুরুষদের বিশ্ব ফুটবলের র্যাঙ্কিং-এ এই মুহূর্তে প্রথম ১০০-তে ভারত। গত দুই দশকে এটাই দেশের সেরা পারফরম্যান্স। সামনেই ভারতের বুকে অনুর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ। কিন্তু, এসবকেই ছাপিয়ে এখন একটাই প্রশ্ন সত্যি সত্যি
আইলিগ না আইএসএল? এই নিয়ে এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা ভারতীয় ফুটবলের। সন্দেহ নেই আবির্ভাব লগ্ন থেকেই প্রচুর পরিমাণ স্পনসর এবং অর্থ নিয়ে ভারতীয় ফুটবলে চমক তৈরি করেছে আইএসএল। সেখানে আইলিগে অর্থ আনতে হিমশিম অবস্থা এআইএফএফ-এর। এমনকী অর্থের অভাবে গত এক দশকে বহু দল ভারতীয় ফুটবলের জাতীয়লিগের আঙিনা থেকে হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে আইএসএল-এর খেলা দলগুলির কাছে কোটি কোটি টাকার ছড়াছড়ি। বেসরকারি এই ফুটবল লিগে খেলা ভারতীয় ফুটবলাররা রাতারাতি হয়ে যাচ্ছেন কোটিপতি।
আইএসএল-এর সংগঠক আইএমজিআর এবার চাইছে সরকারিভাবে জাতীয় সম্মান। তাঁদের ইচ্ছে আইলিগ নয় আইএসএল-কেই দেওয়া হোক জাতীয় লিগের তকমা। আইলিগের সংগঠক এআইএফএফ। সুতরাং, আইএসএল সংগঠকরা চাইলেই যে তাতে জাতীয় লিগের তকমা দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় তা পরিষ্কার। তারমধ্যে আইলিগ-এ খেলে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাব। ভারতীয় ফুটবলকে বিশ্ব আঙিনায় নিয়ে যেতে এই দুই ক্লাবের অবদান ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে এই দুই ক্লাবের ভক্ত সংখ্যার ধারে-কাছে আসে না আইলিগের অন্য দল বা আইএসএল-এর দলগুলি। এমনকী আইলিগ হল ফিফা অনুমোদিত জাতীয় লিগ।
আইএমজিআর-এর কাছে এখন একটাই রাস্তা যদি আইলিগ-এর জনপ্রিয় দলগুলিকে আইএসএল-এ নিয়ে আসা যায়। সেক্ষেত্রে আইএসএল-এর জাতীয় লিগের তকমা পাওয়ার রাস্তাটা অনেকটা সুগম হতে পারে বলেই মনে করছে তারা। বছর খানেক ধরেই মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, বেঙ্গালুরু এফসি-সহ আইলিগের আরও কিছু দলকে আইএসএল-এ ঢোকানোর চেষ্টা করছে আইএমজিআর। আইএসএল-এর চোখ ধাঁধানো গ্ল্যামার মন টেনেছে কলকাতা ময়দানের দুই প্রধানেরও। কিন্তু, আইএসএল-এ খেলতে আগ্রহী হলেও নাম নথিভুক্তকরণের জন্য কোনও অর্থরাশি দিতে রাজি নয় মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল। সেকথা স্পষ্ট করে এআইএফএফ-কেও জানিয়ে দিয়েছে তারা। সম্প্রতি মুম্বইয়ে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকও হয়। যেখানে আইলিগ খেলা ক্লাবগুলির কর্তারা, এআইএফএফ-এর প্রতিনিধি এবং আইএমজিআর-এর কর্তা্রা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু, এই বৈঠকেও কোনও সমাধান সূত্র বের হয়নি। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল স্পষ্টতই জানিয়েছে আইএসএল-এ খেলতে তারা ফ্রাঞ্চাইজি ফি হিসাবে ১৫কোটি টাকা দিতে পারবে না।
কলকাতার দুই প্রধানেরই যুক্তি তাঁদের বিশাল ফ্যান বেস-কে আইএসএল-এর জনপ্রিয়তায় ব্যবহার করতে চাইছে আইএমজিআর। এমনকী শুরু থেকেই আইএসএল-কে তারা সহযোগিতা করে এসেছেন। দলের ফুটবলারদের আইএসএল-এ খেলতে বাধা দেয়নি দুই প্রধান। ভারতীয় ফুটবলের স্বার্থেই তাঁরা এটা করেছেন বলেও দাবি মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের। তাই আইএসএল খেলতে হলে কেন দুই প্রধানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাগান ও ইস্টের কর্তারা।
মোহনবাগান ফুটবল সচিব সৃঞ্জয় বসুর অভিযোগ, 'ফুটবলের স্বার্থে তাঁরা সবসময়েই আছেন। কিন্তু, সব কাজই নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্যে দিয়ে হওয়া উচিত। কিন্তু, আইএমজিআর সেটা এখন আর মানতে চাইছে না।' ইস্টবেঙ্গল-এর সহ-সচিব শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, 'দেশের সর্বোচ্চ লিগ খেলতে তাঁরা কোনও অর্থমূল্য জমা করতে পারবেন না।'
আইএসএল-এর নিলামে অংশ নেওয়য়ার জন্য দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ২৬ মে। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল সেই দরপত্র তুললেও জমা করেনি। আইলিগ-এর দল বেঙ্গালুরু এফসি দরপত্র জমা করেছে। কারণ, আইএসএল শুরু সময়ই শিল্পপতি সজ্জন জিন্দলদের অর্থে চলা এই ক্লাবটি একবার দরপত্র তুলেছিল। পুনরায় তারা আইএসএল-এ ঢোকার চেষ্টা করছে। ফলে অর্থবলে কলকাতার দুই প্রধানের থেকে অনেক এগিয়ে বেঙ্গালুরু এফসি।
এদিকে, দেশের সর্বোচ্চ লিগ-ই খেলতে চায় আইজল এফসি। একথা তারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে এআইএফএফ-কে। দুই প্রধানের মতো তাঁদেরও দাবি এর জন্য কোনও অর্থরাশি তাঁরা জমা করতে পারবে না।
আইলিগ না আইএসএল- দেশেক সর্বোচ্চ ফুটবল লিগ কোনটা হবে? এই নিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে কিছুদিন আগে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ যুব ক্রীড়া দফতরের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বা্সের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক হয় দুই প্রধানের কর্তাদের। এরপর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বৈঠক করেন। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল বাঙালি ঐতিহ্যের অহংকার এবং ভারতীয় ফুটবলে তাঁদের অবদান ভুললে চলবে না বলেও পরোক্ষে এআইএফএফ-কে বার্তা দিয়েছেন মমতা।
কোটি কোটি টাকার ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি জমা না করে দেশের সর্বোচ্চ লিগ খেলার দাবিতে দুই প্রধানের পাশেই দাঁড়িয়েছে আইএফএ। কানাঘুষোয় খবর, আইএমজিআর-এর চাপের মুখে আইএসএল-কে যদি দেশের সর্বোচ্চ লিগের সরকারি তকমা দিয়ে দেওয়া হয় এবং মোহনবাগান এবং ইস্টবঙ্গলের শর্ত না মানা হয় তাহলে 'বেঙ্গল প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ' নামে একটি লিগ চালু করা হতে পারে। এতে খেলার ব্যাপারে নাকি ইতিমধ্যে আইলিগ জয়ী আইজল এফসি সম্মতিও জানিয়েছে।
ভারতীয় ফুটবলের এই হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতে ৭ জুন কুয়ালালামপুরে বসছে এএফসি-র বিশেষ সভা। যেখানে আইলিগের দলগুলি এবং এআইএফএফ-এর সভাপতি প্রফুল প্যাটেল উপস্থিত থাকছেন। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের প্রতিনিধিরাও কোমর বেঁধে ওই সভায় হাজির থাকতে চাইছেন। আইজল এফসি-র কর্তারাও দুই প্রধানের কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন।
ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির কথা বলে যেভাবে আইএসএল-কে পোস্টার বয় করা হচ্ছে তা নিয়ে অনেক প্রশ্নই আছে। ইস্টবেঙ্গলের সহ-সচিব শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্তর মতে, 'দেশি-বিদেশি ফুটবলার খেলানোর প্রশ্নে আইলিগে ভারতের ছেলেদের খেলার সুযোগ অনেক বেশি। সেখানে আইএসএল-এ নামী-দামি বিদেশিদেরকে খেলানো না গেলে স্বত্ব খেলাপের প্রশ্ন উঠবে।' অন্যদিকে, মোহনবাগান সচিব সৃঞ্জয় বসুর মতে, 'সহযোগিতা আমরাই করে থাকি। আমরা সহযোগিতা না করলে আইএসএল-এ ফুটবলার ছাড়ার কথা নিশ্চয় ভাবতাম না।'
ভারতীয় ফুটবলের এই জটিল আবর্তে এখন এমনই অবস্থা যে দল-বদলের মতো বিষয়টিও কল্কে পাচ্ছে না। ইস্টবেঙ্গল আগের দলের কিছু ফুটবলারকে ছেড়ে নতুন ফুটবলার আনার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও সবুজ-মেরুন তাবুতে এখন তেমন কোনও তৎপরতা নেই। আসলে কলকাতার দুই প্রধানের কর্তারাই মনে করছেন আগে দেশের সর্বোচ্চ লিগ নিয়ে জটিলতা কাটা উচিত।
আইএসএল-এর বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে কেউই প্রশ্ন তুলছেন না। কিন্তু, এতে ভারতীয় ফুটবলের কতটা ভাল হয়েছে সেই তর্জা কিন্তু আছে। কারণ, এই আইএসএল-এর চক্করে রহিম নবির মতো ফুটবলার আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় ফুটবলের মূলস্ত্রোতেই নেই একসময়ে দেশের প্রতিভাবান এই ফুটবলারটি। শুধু নবি নন এমন আরও বেশকিছু ফুটবলার আইএসএল-এর পর সেভাবে ভারতীয় ফুটবলের প্রতিনিধিত্ব করতেই পারেননি।
ভারতীয় ফুটবলের একটা মহলের দাবি, আসলে দেশের সর্বোচ্চ লিগের তকমা না পেলে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠতে পারছে না আইএসএল। আর বিশেষ করে এই লিগে যদি মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাবগুলি খেলতে শুরু করে তাহলে তাঁদের ভক্তদের ভিড়ে মাঠ ভরে উঠবে। স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে দর্শকদের জয়ধ্বনি, আর দেশি-বিদেশি ফুটবলারদের মিশেলের লড়াই- এটাকেই ভারতীয় ফুটবলের বাণিজ্যিকীকরণের হাতিয়ার করতে চাইছে আইএমজিআর। কিন্তু, আইলিগ খেলা দলগুলি আইএসএল-এ না এলে সেটা যে সম্ভব নয় তা ভালমতই বুঝেছে আইএমজিআর।
কোনওভাবে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল বা আইজল এফসি-দের শর্ত মানা হলেও তাতে ইতিমধ্যে আইএসএল-এ থাকা অন্যদলগুলি যে আপত্তি তুলবে না এমনটা বলা যাচ্ছে না। কারণ, আইএসএল-এ দল কেনার সময় প্রত্যেককেই কোটি কোটি টাকার ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি দিতে হয়েছে। আইএসএল-এর অন্যতম শর্ত হল এক শহর একটা দল। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল আইএসএল-এ খেললে তাহলে অ্যালটেকিকো দি কলকাতার কী হবে? আবার মোহনবাগান বা ইস্ট অন্য শহরের প্রতিনিধি হিসাবে খেলতে রাজি হবে তো? প্রশ্নই অনেক, কিন্তু কোনওকিছুরই সুস্পষ্ট উত্তর নেই। তবে, সন্দেহ নেই ভারতীয় ফুটবল এখন এক জটিল আবর্তে। এর উত্তর হয়তো কিছুটা মিলবে ৭ জুন। কুয়ালালামপুর বৈঠকে।