উত্তেজনার পারদে মোড়া এক নাটকীয় ম্যাচ, কলম্বিয়ার উত্থানে বিদায় সেনেগালের
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস না ভুল গেম রিডিং? বিশ্বকাপ থেকে সেনেগালের বিদায়ের জন্য দায়ী কোনটা? বৃহস্পতিবার গ্রুপ এইচ-এর ম্যাচের পর এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। গ্রুপ এইচ-এ সবচেয়ে সুবিধা জনক জায়গায় ছিল সেনেগাল।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস না ভুল গেম রিডিং? বিশ্বকাপ থেকে সেনেগালের বিদায়ের জন্য দায়ী কোনটা? বৃহস্পতিবার গ্রুপ এইচ-এর ম্যাচের পর এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। গ্রুপ এইচ-এ সবচেয়ে সুবিধা জনক জায়গায় ছিল সেনেগাল। যাঁরা আফ্রিকান ফুটবল শিল্পের পরিপূর্ণ প্রকাশের জন্য সেনেগালকে সমর্থন জানান তাঁরা আজ আশাহত। ২০০২ সালের পর সেনেগাল এবারের বিশ্বকাপে অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছিল। আপাতত সেই সব স্বপ্নের সমাধি। কারণ, এদিনের ম্যাচে কলম্বিয়ার কাছে ১-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে সেনেগাল।
ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১৮-র গ্রুপ এইচ-এর পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে সেনেগাল জাপানের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করেছিল। পোল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়েছে। বিপক্ষের গোলে মোট ৪বার বল ঢুকিয়েছে। নিজেরা গোল খেয়েছে ৩টি। কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ড্র করলেই ২০০২ সালের পর বিশ্বকাপের শেষ ষোলয় পৌঁছনো ছিল সেনেগালের নিশ্চিত গন্তব্য।
এই ড্র-এর নিশ্চিন্ততা যে কতটা ভয়ঙ্কর তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সেনেগাল। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে সেনেগালের এই জাতীয় দলটি ২০০২ সালের দলটির থেকেও শক্তিশালী ছিল। তারউপরে সেনেগালের এই দলের কোচ ২০০২ সালে সেনেগাল জাতীয় দলের সদস্য অ্যালিউ সিসে। যিনি কার্যত একক দক্ষতায় সেই বিশ্বকাপে সেনাগালকে শেষ ষোলয় তুলেছিলেন। কিন্তু, এই সেনেগাল দলটি বৃহস্পতিবার অদ্ভুতভাবে খেলার মাঝপথে যেন দাঁড়িয়ে গেল।
কলম্বিয়ার আক্রমণভাগের মূল মুখ জেমস রডরিগেজে চোটের জেরে খেলা শুরুর মাত্র তিরিশ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে যান মাঠ থেকে। রডরিগেজের বেরিয়ে যাওয়া কলম্বিয়া দলকে মানসিকভাবে মারাত্মক রকমের ধাক্কা দিয়েছিল। কিন্তু এই সুযোগে ছন্নছাড়া কলম্বিয়ার উপরে চেপে বসতে ব্যর্থ হয় সেনেগালিসরা। বরং এই সময়ও তেড়েফুড়ে আক্রমণে যাওয়ার বদলে খেলার গতিকে স্লথ করে দেওয়ারই উপরই যেন জোর দেন সেনেগালের কোচ সিসে। গোল খাবো না, সুযোগ পেলে গোল দেব- এই করতে গিয়ে রক্ষণাত্মক ফুটবলের মোড়কে সেনেগালিসরা ঢুকে যেতেই যেন সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল কলম্বিয়া।
ফুটবল কোচিং-এ মাথার চুল পাকিয়ে ফেলা জোসে পোকেরম্যান বুঝে যান কলম্বিয়াকে জয় এনে দিতে এটাই সুযোগ। চাই একটা ঝটকা আক্রমণ। আর একটা দমকা বাতাস। যা এলোমেলো করে দেবে সেনেগালের রক্ষণের মানসিকতা। প্রতিপক্ষের এই অসতর্কতার মুহূর্তে তুলে আনতে হবে গোলটি। ফলে চট জলদি তিনি মাঠে পরিবর্তিত হিসাবে নামিয়ে দেন ইয়েরি মিনাকে। চনমনে ও অল্পবয়সী মিনা ছটফটে ও লম্বা দোঁড়ের জন্য নাম আছে। পাশাপাশি মিনা ভালো হেডার। পোকেরম্যান বুঝেছিলেন যে কোনও মুহূর্তে সেনেগাল বক্সের আশপাশে ফ্রি-কিক পেলে মিনা হয়ে উঠবেন তুরুপের তাস।
পোকেরম্য়ান যে ভাবে গেম রিডিং-এ সারাক্ষণ জয়ের রাস্তা খুঁজছিলেন, সিসে হয়তো কোচিং-এ তেমন অভিজ্ঞতা না থাকায় খেয়ালই করেননি যে ৫১ মিনিটে তাঁর দলের নিয়াঙ্গ হলুদ কার্ড দেখে নিয়েছেন। সুতরাং, কলম্বিয়ার কাছে সেনেগাল যদি ম্যাচ হারে এবং অন্যদিকে পোল্যান্ডের কাছে জাপান হেরে যায় তাহলে দু'দলের পয়েন্ট সমানই থাকবে। কিন্তু, তখন কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে ফেয়ার প্লে নিয়ম প্রযোজ্য হবে। আর জাপান যদি সারা ম্যাচে কোনও কার্ড না দেখে থাকে তাহলে জাপান দ্বিতীয় দল হিসাবে শেষ ষোলয় ঢুকে পড়বে।
পোকেরম্যান যেভাবে ভেবেছিলেন মিনা সেইভাবেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। সুযোগটা এল ৭৪ মিনিটে। সেনেগালের বিরুদ্ধে কলম্বিয়ার কর্নার কিকটা গোলের সামনে ভেসে আসতেই মিনা নিশানা বেছে নিতে ভুল করেননি। ৬ফুটেরও বেশি লম্বা মিনা শক্তিশালী হেডে বল ঢুকিয়ে দিতেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন পোকেরম্য়ান। ম্যাচের এমন টার্নিং পয়েন্টে স্বাভাবিকভাবেই দিশেহারা দেখাচ্ছিল সেনেগাল দলটিকে। কারণ ৫১ মিনিটের হলুদ কার্ড আর ৭৪ মিনিটে গোল খাওয়া সেনেগালের অবস্থা ২ গোলে ম্যাচ হারতে বসা দলের মতো। কোচ সিসের কাছেও যে শেষমুহূর্তের এইি গোলের পাল্টা উত্তর দেওয়ার প্ল্যান নেই তা বোঝাই যাচ্ছিল। ফলে হাতে ১৮ মিনিট থাকলেও কলম্বিয়ার গোলের সামনে দরজা খুলতে পারেনি সেনেগাল। এর সঙ্গে ছিল কলম্বিয়ার গোলরক্ষক ওসপানিয়ার দুরন্ত ফর্ম। ফলে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির দোরগোড়া থেকে বিদায় নেওয়া ছাড়া সেনেগালের কাছে আর কোনও রাস্তা ছিল না।
অথচ, বিশ্বকাপের পরবর্তীধাপে সেনেগালের নিশ্চিন্ত অগ্রগতি নিয়ে প্রায় একপ্রকার আত্মবিশ্বাসী ছিলেন সেনেগালের সমর্থকরা। কলম্বিয়া সমর্থকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁরাও রঙিন সাজে সামারা এরেনা ভরিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু, এভাবে যে উৎসবের আনন্দের সমাপ্তি ঘটবে তা ভাবতে পারেননি সেনেগালের সমর্থকরা।