ময়দানে ফের রক্তের ছিটে, দুই প্রধানের সমর্থকদের মারপিটে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে অনির্বাণ
ফুটবল মানেই গতি, মাঠের মধ্যে এক চামড়ার বল নিয়ে অ্যাথলেটিজমের চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ। আর এই গতি ও অ্যাথলেটিজমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক আবেগ।
ফুটবল মানেই গতি, মাঠের মধ্যে এক চামড়ার বল নিয়ে অ্যাথলেটিজমের চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ। আর এই গতি এবং অ্যাথলেটিজমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক আবেগ। যার টানে শুধু ফুটবলরারই নন ভেসে যান ফুটবলপ্রেমীরাও। এই আবেগের বহর এতটাই যে জীবনে সবকিছু হারিয়ে ফেলা মানুষটাও ঘুরে দাঁড়ানোর শপথ নিয়ে ফেলেন।
এই আবেগের বাঁধনহারা গতি অবশ্য অনেককিছু শিখিয়ে দিয়েও যায়। এই শিখিয়ে দেওয়াটা এতটাই কঠিন ও রুঢ় বাস্তবতায় ভরপুর যে তার আঘাত সহ্য করা যে কারোর পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়ে। কলকাতা ময়দানে এমনই এক ঘটনা ঘটল। এর ফলে এখন উঠতে শুরু করেছে নানা প্রশ্ন।
তারিখটা ছিল ১৯ জুলাই, ২০১৮। আর পাঁচটা দিনের মতোই শুরু হয়েছিল। তবে, সকল লাল-হলুদ সমর্থকের মতো একটু অন্য ভাবেই দিনটা শুরু করেছিলেন হিন্দমোটরের বাসিন্দা অনির্বাণ কংসবণিক। কারণ বাঙালির চির আবেগের ম্যাচে যে সেদিন মোহনবাগানের বিরুদ্ধে আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে মাঠে নামবে ইস্টবেঙ্গল! হোক না ছোটদের ডার্বি, তাতে কী! ম্যাচটা যখন লাল-হলুদ বনাম সবুজ-মেরুনের, তখন কী আর প্রস্তুতির কোনও অভাব থাকলে চলে!
সকালেই বাড়িতে বলে গিয়েছিলেন, আজ শিল্ড জিতেই বাড়ি ফিরব। কথা রেখেছেন অনির্বাণ। কিন্তু যে ভাবে তিনি বাড়ি ফিরলেন, সে রকমটা কথা ছিল না। সুস্থ শরীরে হাসতে হাসতে বাড়ি থেকে বেড়নো অনির্বান বাড়ি ফিরেছিলেন মাথায় পাঁচটা সেলাই নিয়ে। ছেলের এই অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনির্বাণের মা।
সোমবার রাত থেকে অবস্থার অবনতি ঘটে অনির্বাণের। অনির্বাণকে বড় নার্সিংহোমে রাখার ক্ষমতা নেই তাঁর পরিবারের। হিন্দমোটর স্টেশনের পাশে ছোট একটা বাসনের দোকান সামলান অনির্বাণের বাবা দ্বিজেন কংসবণিক। এই দিয়ে কোনও মতে সংসার চলে।
দ্বিজেনের জীর্ণ শরীরের মতোই জীর্ণ সেই দোকানের অবস্থাও। যদিও বা একটা বড় অবলম্বন ছিল লাখখানেক টাকা, তাও মাস কয়েক আগেই নিজের চোখের চিকিৎসার জন্য খরচ করে ফেলেন তিনি।
এমন এক আর্থিক অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই অসুস্থ অনির্বাণকে বড় কোনও হাসপাতালে ভর্তি করার সামর্থ্য ছিল না দ্বিজেনের। প্রতিবেশীদের দেওয়া আর্থিক সাহায্যে অবশেষে অনিবার্ণকে তপসিয়ার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু, অবস্থার অবনতি ঘটায় রাতেই আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয় অনির্বাণকে।
ছেলের চিকিৎসা নিয়ে প্রবল দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যান দ্বিজেন। অবশেষে আশার আলো জ্বালেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। অনির্বাণের শরীরী অবস্থার বিশেষ কিছু উন্নতি না হলেও, তাঁর চিকিৎসায় যাতে কোনও ফাঁক না থাকে, সেই কারণে উদ্যোগী হন অসংখ্য লাল-হলুদ সমর্থক এবং একাধিক ফ্যান্স ক্লাব।
মঙ্গলবার দুপুর থেকেই বিভিন্ন হোয়াটস্যাপ এবং ফেসবুকের গ্রুপে অনির্বাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তাঁর বাবা দ্বিজেনবাবুর স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার পাসবুকের ছবি ছড়িয়ে দেন বিভিন্ন সমর্থক। তরুণ-প্রাণকে বাঁচাতে বহু মানুষ নিজেদের সাধ্য মতো দান করেছেন দ্বিজেন কংসবণিকের অ্যাকউন্টে।
২০১২ সালে এই একই ভাবে ইঁটের আঘাতে প্রায় প্রাণ হারানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সৈয়দ রহিম নবির জীবনে। সেদিন ফুটবলপ্রেমীর বেশধারী একদল বর্বরের ইঁটের আঘাতে ভারতীয় ফুটবল হারাতে বসেছিল তার এক কৃতি সন্তানকে। শুধু রহিম বা অনির্বাণ নয়, অতীতেও এই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ভারতীয় ফুটবল।
ভারতীয় ফুটবলে অন্যতম বড় আকর্ষণ ডার্বি বা বাঙালির বড় ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের চিরকালীন এই দ্বৈরথ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এই ম্যাচকে কেন্দ্র করে যেমন আন্দোলিত হয়েছে গ্যালারি, তেমনই গর্জে উঠেছে বাইশ জোড়া পা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে ফুটবলেরই। কখনও জিতেছে ইস্টবেঙ্গল, কখনও মোহনবাগান। এই ডার্বিকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত যে হিংসার ছবির সাক্ষী থাকছে কলকাতা ময়দান বা ভারতীয় ফুটবল, তা অচিরেই যদি বন্ধ না করা সম্ভব হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই এমন অনেক ঘটনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, যা শুধু ফুটবলকেই কলঙ্কিত করে না, কঙ্কিত করে মানব জাতিকেও।