অরুণ-লুদমিলার হাত ধরে রাশিয়া বিশ্বকাপের সঙ্গে জুড়ে গেল কলকাতার নাম, পড়ুন এক অসামান্য কাহিনি
অরুণ সোম আর লুদমিলার ফ্ল্য়াটের জানলা দিয়ে আজকাল আলোর ছায়ায় যেন খেলা করে যায় বিশ্বকাপ। কেমন আছে রাশিয়া? কেমন আছে মস্কো?
অরুণ সোম আর লুদমিলার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে আজকাল আলোর ছায়ায় যেন খেলা করে যায় বিশ্বকাপ। কেমন আছে রাশিয়া? কেমন আছে মস্কো? এই প্রশ্ন সমানে যেন ঘুরপাক খায় এই হাফ ইন্ডিয়ান আর হাফ রাশিয়ান দম্পতির বাসগৃহে। যদিও, রাশিয়া থেকে গড়িয়ার শ্রীরামপুরে অরুণ ও লুদমিলার ফ্ল্যাটের দূরত্ব কয়েক হাজার কিলোমিটার। এককালে মস্কোর বুকে যে সংসার ফেলে কলকাতার বুকে বাড়ি জমিয়েছিলেন সোম দম্পতি সেখানে এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে রাশিয়ার ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনা। অনেকটা বাঙালির দুর্গাপুজো সেলিব্রেশনের মতো। মিডিয়ার ফোন, সাংবাদিকদের আনাগোনা- সোম দম্পতি আজ বড়ই ব্যস্ত।
লুদমিলা আজ প্রৌঢ়ত্বের কোঠায়। শরীরটাও সবসময় ঠিক থাকে না। রাশিয়া-মস্কো নিয়ে তাঁর মনেও অনেক কথা। কিন্তু, সে সব আর বলা হয়ে ওঠে না বাইরের কাউকে। কারণ শরীরটা যে বাধ সাধে। তবে, এখনও তরতাজা অরুণ সোম। বাংলায় অধ্যাপনা করতে করতেই ছুটে ছিলেন সোভিয়েত দেশের টানে- সোজা মস্কো। রুশ ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করতে করতেই দেশটাকে ভালবেসেছিলেন কলকাতার তরুণ অরুণ। সময়টা পঞ্চাশের দশকের শেষ লগ্ন। পড়াশোনা শেষ হতেই ঘরের ছেলের ঘরে ফেরা। কিন্তু রুশ দেশটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন কই। কারণ মন পড়ে রয়েছে লুদমিলার কাছে। মস্কোর রুশ তরুণী। যিনি আবার মস্কোর বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনার কাজ করেন।
মস্কো থেকে চাকরির ডাক আসতেই ফের ভেসে পড়া কলকাতার অরুণের। এরপর দীর্ঘ কয়েক দশকের প্রবাসের জীবন। লুদমিলার সঙ্গে সংসারে তখন ঘরে দুই মেয়ে ঋতা ও স্মিতা। মস্কোর আকাশ-বাতাস সমাজতন্ত্রের পরকাষ্ঠায় হাসি-খুশি এক সংসার নিয়ে বয়ে যাচ্ছিল অরুণ ও লুদমিলার জীবনের নৌকা। বাধ সাধল সাবেক সোভিয়েতের পতন। এবার আরও এক লড়াইয়ে নামলেন অরুণ ও লুদমিলা।
মস্কোর আকাশ-বাতাস, চারপাশের পরিচিত মানুষগুলোকে টা-টা জানিয়ে এবার লুদমিলা এলেন অরুণের নিজের শহর কলকাতায়। আর সেই থেকেই অরুণ ও লুদমিলার স্থায়ী ঠিকানা কলকাতার পাটুলি উপনগরী। রাশিয়া-মস্কো প্রায় যেন স্মৃতির কোঠায়। দুই মেয়ের মধ্যে বড় ঋতা এখন জলপাইগুড়ি কলেজে বোটানির অধ্য়াপিকা, আর ছোট মেয়ে স্মিতার ঠিকানা দিল্লির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজি। স্মিতা সেখানে ফ্যাশনের পাঠ পড়ান ছাত্র-ছাত্রীদের।
রুশ দেশের সেই ফেলা আসা সংসার আজ মেসি-রোনাল্ডো-নেইমারদের বিশ্বযুদ্ধের দৌলতে পাটুলি উপনগরির সোম দম্পতির রোজকার জীবনে বারবার ফিরে আসছে। পড়াশোনাটাই নেশা অরুণ সোমের। এখনও সমানতালে দেশ-দুনিয়ার সমস্ত খবর রাখেন। আর তাই যেভাবে ভারতীয় মিডিয়া এবং তাতে মতামত দেওয়া বিশেষজ্ঞরা রাশিয়ার সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, মানুষদের নিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে চলেছেন তা মানতে পারছেন না অরুণ সোম।
রুশ দেশ বললে যেমন বিশ্ববিখ্যাত সব রূপকথার কথা মনে আসে তেমনি আসে সেখানকার ফুলেদের কথাও। অথচ, ভারতীয় মিডিয়ায় অনেকে নাকি বলে বেড়াচ্ছেন রুশরা ফুল পছন্দ করেন না। কিন্তু, আশ্বর্যের বিষয় মস্কোর রাস্তায় 'মা'-এর স্মৃতি সৌধের তলায় এখন ফুলের সমাহার। আর ফুল রুশ সংস্কৃতির সৌজন্যের ধারক ও বাহক। অরুণের কথায় রুশিরা একে অপরকে ফুল দিয়েই অভিভাবদন করতে পছন্দ করে। মস্কোর বুকেই রয়েছে একাধিক সব ফুলে বাজার। এমনকী, দেশীয় মিডিয়ার আরও এক ধরণের কূপমুণ্ডকতায় মনক্ষুণ্ণ এই প্রবীণ। আর সেটা হল রুশ-রা নাকি হাসতে জানে না! এমনকী রসিকতা থেকেও নাকি তারা শতহস্ত দূরে থাকে! তাঁর সাফ কথা রুশরা যদি হাসতেই না জানে বা রসিকতা বোধ না থাকে তাহলে স্তালিনের জামানার বিখ্যাত হাস্যকৌতুকগুলো এল কোথা থেকে! রুশিরা একে অপরকে নিয়ে যথেষ্টই ঠাঠ্ঠা-তামাশা করতে অভ্যস্ত। এমনকী অরুণের কথায় রুশদের প্রচুর চুটকিও আছে যা শুনলে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যাবে।
রাশিয়া নিয়ে যে বিতর্ক থাকবে তাতে অবাক হচ্ছেন না অরুণ সোম। কারণ বিশ্বজুড়ে যে ব্যালান্স অফ পাওয়ার-এর খেলা হয় তাতে রাশিয়াকে বেলাইন করা যায়নি। সোভিয়েতের পতনের পর পশ্চিমি দুনিয়া মনে করেছিল রাশিয়া শেষ। কিন্তু, এক দশকের মধ্যেই তাকে ভুল প্রমাণিত করে এখন আন্তর্জাতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে রাশিয়া। সুতরাং, এহেন রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বিতর্ক যে হবে তা বিশ্ব জানে বলেই মনে করছেন অরুণ। আর ফুটবল বিশ্বকাপের বিতর্কেই বারবার জড়িয়ে পড়ছেন অরুণ, লুদমিলা, ঋতা, স্মিতা-রা। কারণ, মস্কোর এক টুকরো আকাশ এখনও যে তাঁদের মনের মধ্যে পেখম মেলে উড়ে বেড়ায়।