বিশ্বকাপ কেড়ে নিল দুই, বদলে দিল এক, এগিয়ে চলল ইতিহাসের পাতা
শনিবার বিশ্বকাপে অস্ত গেলেন মেসি ও রোনাল্ডো, তবে উদয় হল নতুন তারকা কিলিয়ান এমবাপের।
খেলাধূলার জগতের সবচেয়ে বড় টুর্ণামেন্ট ফিফা বিশ্বকাপ। এই টুর্ণামেন্ট জন্ম দেয় নতুন তারকার, আবার কখনও খালি হাতে ফেরায় মহাতারকাদের। শনিবার রাতেও যেমন বিশ্ব দেখল একই দিনে দুই মহাতারকার বিদায়। তারপর ফুটবল বিশ্ব ভাবতে বসেছে আর কী বিশ্বকাপ দেখব? তারকা ম্য়াজিকই যে আর নেই। কিন্তু তাদের নিশ্চিন্ত করতই যেন একই দিনে বিশ্বকাপ উপহার দিল নতুন এক তারার। তিনি কিলিয়ান এমবাপে।
একই দিনে সারা বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্তের মন ভেঙে গিয়েছে। শনিবারের প্রথম ম্যাচে বিদায় নেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা লিওনেল মেসি। এই বিশ্বকাপে অবশ্য তাঁকে দেখা যাওয়ার কথাই ছিল না। কনফেডারেশন কাপের ফাইনালের পরই দেশের জার্সি তুলে রেখেছিলেন তিনি।
তারপরেও আর্জেন্টিনা যখন বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারবে না মনে হচ্ছে তখন তাঁকে অবসর ভেঙে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশকে বিশ্বকাপে তুলে একবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন মেসি। কিন্তু শনিবার রাতে সব আশার সমাধী ঘটে গেল। এই বিশ্বকাপে মেসি-ম্যাজিক আর দেখা যাবে না, তা নিশ্চিত। আর কোনদিন আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলবেন কিনা তাও এখনও নিশ্চিত নয়। তবে না খেলার সম্ভাবনাই বেশি।
এরপর পরের ম্যাচে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দাপট দেখতে বসেছিলেন ফুটবল ভক্তরা। এতদিন পর্যন্ত স্রেফ ব্যক্তিগত দক্ষতায় দলকে টেনেছিলেন পর্তুগীজ মহাতারকা। তাই এদিনও তিনিই পার করে দেবেন আশা করেছিলেন ফুটবল ভক্তরা। কিন্তু সেখানেও হতাশাই অপেক্ষা করে ছিল। উরুগুয়ের কাছে হেরে বিদায় ঘটেছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বাহিনীরও।
ক্রিশ্চিয়ানোর যা বয়স তাতে ফুটবল দুনিয়া ধরে নিচ্ছে পরের বিশ্বকাপে তিনি আর খেলবেন না। কিন্তু পরের কথা পরে। এই বিশ্বকাপে আর কি পরে রইল তা নিয়েই আলোচনা চলছে। এবারের বিশ্বকাপ কিন্তু দেখিয়েছে অনেক পরিবর্তন। দেখিয়েছে ক্রিড়া বিজ্ঞান এতটাই এগিয়েছে যে 'ছোট দল' আর 'বড় দল'-এ বিশেষ ফারাক থাকছে না। দেখিয়েছে লাতিন ঘরানা বা ইউরোপীয় ঘরানা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সব মিলে মিশে মিশ্র ঘরানা হয়ে গিয়েছে। এরমধ্যে ব্যক্তিগত দক্ষতায় তফাত গড়ে দেন রোনাল্ডো-মেসিরাই।
এতকিছু পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও যেটা পাল্টায়নি, সেটা হল বিশ্বকাপে তারকা পূজো। ইতিহাস বলছে ফুটবল বিশ্ব বিশ্বকাপকে মনে রেখেছে তারকা দিয়েই। কোনও বিশ্বকাপ ছিল পেলের, কোনওটা মারাদোনার, কোনওটা বা জিদানের - এরকম। কাজেই রোনাল্ডো-মেসির মতো মহাতারকাদের বিদায়ে বিশ্বকাপ জৌলুস হারালো তা বলাই বাহুল্য।
অনেকেই ভাবছেন, এরপর বিশ্বকাপে তো খেলা হবে শুধু। শিল্পও থাকবে। কিন্তু মাতারকাদের যে আবেগ তা থাকবে না। থাকবে না মেসির বাঁপায়ে বল ধরে তিন টাচে গোল করা, থাকবে না প্যান্ট গুটিয়ে দৃড় প্রতিজ্ঞ মুখে রোনাল্ডোর ফ্রিকিক নিতে যাওয়া।
তবে বিশ্বকাপ হল সমুদ্রের মতো, কিছু যেমন নিয়ে নেয়, কিছু ফিরিয়েও দেয়। ১৯৯৮ সালে যেমন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন বিশ্বকাপ যাচ্ছে রোনাল্ডোর ব্রাজিলের হাতে। কিন্তু রোনাল্ডোকে ম্লান করে বিশ্বমঞ্চে জ্বলে উঠেছিলেন এক জিনেদিন জিদান। খেলোয়াড় হিসেবে তারকা খেতাব জিদানের আগেই থাকলেও ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জিতিয়েই সত্য়িকারের মহাতারকা হয়ে উঠেছিলেন।
তারকা যেমন মহাতারকা হয়ে ওঠেন তেমনই আবার নতুন তারকারও উদয় হয় বিশ্বকাপের মঞ্চে। কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের রোনাল্ডো-রবার্তো কার্লোসদের সবাই চিনলেও, রোনাল্ডিনহোকে ক'জন চিনতেন? ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর মায়াবি ফ্রিকিকের দৌলতেই তারকা হিসেবে জন্ম নেন উঁচু দাঁতের সদা হাস্যময় এই ব্রাজিলিয়ান।
সেরকম শনিবার বিশ্বকাপ রোনাল্ডো মেসিকে তুলে নিলেও বিশ্ব ফুটবলকে উপহার দিল এক নয়া তারকার। কিলিয়ান এমবাপে। নাত্র ১৯ বছর বয়স এই ফরাসী ফুটবলারের। জিরু, গ্রিজম্য়ান সম্বৃদ্ধ ফরাসী ফরোয়ার্ড লাইনেও প্রতিভার জোরে জায়গা করে নিয়েছিলেন এই তরুন ফুটবলার।
ফ্রান্সের এবারের দল অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রতি পজিশনে বয়সে তরুন, প্রতিভায় দারুন সব ফুটবলার আছেন। গ্রিজম্য়ান, পোগবা, জিরুদের পেছনে ফেলে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ম্যাচে তারকা হয়ে উঠলেন এমবাপেই। প্রথম যে পেনাল্টিটি পেয়েছিল ফ্রান্স তা এই তরুন ফুটবলারের কল্যানেই।
যেমন গতি, তেমন জায়গা নেওয়ার ক্ষমতা, তেমনই সুযোগ সন্ধানী। পেনাল্টি আদায় ছাড়াও আরও দুটি অসাধারণ গোল করেন এমবাপে। আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডারদের ভুল ধরে এমবাপের কৃতিত্বকে ছোট করে দেখলে চলবে না। এমবাপের আগে বিশ্বকাপের ম্যাচে নেমে ১৯ বছর বয়সে ২ গোল করেছিলেন একমাত্র পেলে। এই তথ্যই তাঁর কীর্তিকে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।
এই অল্প বয়সেই তিনি যা পরিণতি দেখিয়েছেন, তাতে বিশেষজ্ঞরা কিন্তু ইতিমধ্যেই এমবাপের উপর বাজি ধরা শুরু করে দিয়েছেন। এই বয়সেই প্রতিভার এই স্ফুরণ দেখে তাঁরা বলেই দিচ্ছেন এমবাপে ভবিষ্যতের তারকা। তবে ভবিষ্যত কেন, এই বিশ্বকাপেই দিদিয়ের দেশঁর দলের সেরা তারকা হয়ে উঠতে পারেন এমবাপে। কাজেই মেসি রোনাল্ডোর বিদায়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এসে গেছেন নতুন তারকা।
আগামী বিশ্বকাপগুলিতে তো বটেই, এই বিশ্বকাপেও চোখ রাখতেই হবে কিলিয়ান এমবাপের উপর। মেসি রোনাল্ডোরা তো তাঁর হাতেই ব্যাটন তুলে দিয়ে গেলেন। এভাবেই তো এগিয়ে যায় ইতিহাসের পাতা, এগিয়ে যায় সময়।