৬৪ বছর বয়সে হাঙর সঙ্কুল সমুদ্রে ১৮০ কিমি সাঁতার! ডায়না নিয়াদের কাহিনি অবাক করবে
৬৪ বছর বয়সে সমুদ্রে দীর্ঘ সময় ধরে এতটা পথ সাঁতার কাটা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। যে কোনও মুহূর্তেই মৃত্যুর মুখে পতিত হতে পারতেন ডায়না।
'যে কোনও বয়সেই স্বপ্ন দেখা যায়'- এটাই বিশ্বাস করেন ডায়না নিয়াধ। বর্তমানে তাঁর বয়স ৬৯ বছর। মার্কিন এই মহিলা একাধারে দীর্ঘ দূরত্বের সাঁতারু, একদিকে মোটিভেশনাল স্পিকার, লেখক এবং সাংবাদিক। এহেন ডায়না ৬৪ বছর বয়সে বিশ্বকে দেখিয়েছেন ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষ কী না করতে পারে।
সালটা ছিল ২০১৩। সেই বছর কিউবা থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত সাঁতার কাটেন ডায়না। সাগরপথে যার দূরত্ব ছিল ১৮০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ সামুদ্রিক পথ পার হতে ৪৯ ঘণ্টা সময় লেগেছিল ডায়নার।
৬৪ বছর বয়সে সমুদ্রে দীর্ঘ সময় ধরে এতটা পথ সাঁতার কাটা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। যে কোনও মুহূর্তেই মৃত্যুর মুখে পতিত হতে পারতেন ডায়না। শারীরিক বিভিন্ন অসুবিধা তো ছিলই, সেই সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ নোনা জলে পড়ে থাকায় ত্বকে নানা ধরনের সমস্যাও হচ্ছিল। এছাড়াও ছিল হাঙর ও জেলিফিসের আক্রমণ। কিন্তু, এই যাত্রায় আর হার মানতে রাজি ছিলেন না ডায়না।
কিউবা থেকে ফ্লোরিডার এই সমুদ্র পথে সারক্ষণই ঘুরে বেড়ায় হাঙরের দল। তাই এই সামুদ্রিক পথে সাঁতারুরা 'শার্ক কেজ' না পরে সাঁতার কাটার সাহস দেখান না। কিন্তু ডায়না সাঁতার কাটতে নেমেছিলেন 'শার্ক কেজ' না পরেই। ডায়না ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি এই 'শার্ক কেজ' না পরেই সাঁতার কাটার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। এই সমুদ্র পথে জেলিফিস উৎপাতও মারাত্মকরকমের। তাই জেলিফিসের লেজের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এক ধরনের মুখোশ ব্যবহার করেছিলেন ডায়না।
১৯৭৮ সালে প্রথমবার কিউবা থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত সাঁতার কাটার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু, পারেননি লক্ষ্যে পৌঁছতে। তখন ডায়নার বয়স ছিল ২৯। অবশ্য কিউবা থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত সাঁতার কাটার ইচ্ছেটা তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিল ৮ বছর বয়সে। ফ্লোরিডার বাড়ি থেকে কিউবায় পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন ডায়না। প্লেন থেকে বিশাল সমুদ্রটাকে দেখে তাঁর স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। সেই সময় কিউবার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালোই ছিল। মার্কিনি অবরোধের কোপ তখন চাপেনি ফ্রিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবার উপরে।
১৯৭৮ সালে ২৯ বছর বয়সে যখন কিউবা থেকে সাঁতার শুরু করেছিলেন নোনা জলে কিছুক্ষণের মধ্যেই হতোদ্যম হয়ে গিয়েছিলেন ডায়না। মাঝপথেই সাঁতার কাটা বন্ধ করে রেসকিউ বোটে উঠে পড়েছিলেন। ২০১০ সালের ১০ জুলাই কিউবা থেকে ফ্লোরিডা সাঁতারের প্রস্তুতি শুরু করেন ডায়না। সে বছরই অগাস্ট অথবা সেপ্টেম্বরে এই সাঁতার কাটবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় এই সূচি পিছিয়ে করা হয় ২০১১ সালের জুলাই-এ।
২০১১ সালে কিউবা থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত সাঁতারে দু'বার চেষ্টা করেন ডায়না। জেলিফিস ও অ্যাসমার আক্রমণে বেশিদূর এগোতে পারেননি তিনি। ২০১২ সালের ফের জয়ের লক্ষ্যে হাভানা থেকে জলে নামেন ডায়না। কিন্তু, জেলিফিসের লেজের আঘাতে এবং প্রবল দুর্যোগের বজ্রপাতে প্রায় মরতে মরতে বেঁচে আসেন তিনি। জল থেকে যখন রেসকিউ বোটে ডায়না উঠে পড়েছিলেন তখন তিনি ১১১ কিলোমিটার অতিক্রম করে ফেলেছিলেন।
এতবারের চেষ্টা, কিন্তু বারবার ব্যর্থতা। হার না মানাটা ডায়না ধাতে। তাই ২০১৩ সালে ফের কিউবা থেকে সাঁতরে ফ্লোরিডার পৌঁছানোর চেষ্টায় জলে নেমে পড়েন তিনি। এবার জেলিফিসের আক্রমণ ঠেকাতে মুখে বিশেষ ধরনের এক মুখোশ ব্যবহার করেন তিনি। কিন্তু, হাঙরের হাত থেকে বাঁচতে কোনও শার্ক কেজ পোশাক না পরেই সাঁতার কাটতে শুরু করেন।
চারবারের চেষ্টায় শেষমেশ সফল হলেন ডায়না। ৬৪ বছরের এক বৃদ্ধার এমন অদম্য মনের জোর দেখে সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। একটানা ৪৯ ঘণ্টা ধরে সাঁতার কেটেছিলেন তিনি। যখনই কোনও ডাঙার পাশ দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে এগোচ্ছিলেন তখন তাঁকে দেখতে সৈকতে উপচে পড়ছিল ভিড়। সকলে মুঠিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে ডায়নাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। আর ডায়নাও পাল্টা হাত তুলে তাঁদের অভিভাবদন গ্রহণ করতে করতে এগিয়ে যান। জেলিফিসের আক্রমণ কম করতে বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। ডায়নার সাঁতারের পথে আগে থেকেই কিছু ডুবুরি জলের তলা থেকে জেলিফিসদের সরিয়ে দিচ্ছিল।
ফ্লোরিডার সৈকতে যখন ডায়না গিয়ে উঠেছিলেন তখন গোটা শরীরটাই নোনা জলের নুনে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। চোখ-মুখ এতটাই ফুলে যায় যে, কোনও সুস্থ মানুষ ভয় পাবেন। এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারিনী হওয়ার পর ডায়না বলেছিলেন, 'এটা একটা সেরা কাহিনি, ৩৫ বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, অবশেষে তা সম্পূর্ন হল। ' আর ডায়না বলেছিলেন, আসলে সব বয়সেই স্বপ্নটা দেখা যায়। আর তা পূরণ করার জন্য বয়স কোনও বাধা নয়। তা না হলে ১৯৫০ সালে যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন তা ২০১৩ সালে বাস্তবায়িত করতে পারতেন না ডায়না।
পরবর্তীকালে ডায়না তাঁর এই সাঁতার জয় নিয়ে একটি বইও লিখেছেন, নাম 'ফাইন্ড আ ওয়ে'। সত্যি সত্যি শেষমেশ জয়ের রাস্তাটা খুঁজে পেয়েছিলেন ডায়না। আর সেটাই বিবৃত করেছেন এই বই-এ। ডায়নার এই অসামান্য কাহিনি নিঃসন্দেহে যে কোনও বয়সের মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার।