চলে গেলেন ব্যাডমিন্টন বিপ্লবী মনোজ গুহ, একটা সময় বিশ্ব ক্রমতালিকায় ছিলেন ৪ নম্বরে
প্রয়াত হলেন ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের প্রথম দিককার তারকা খেলোয়াড় মনোজ গুহ। তাঁর প্রয়াণের জন্য বয়স জনিত কারণ রয়েছে বলেই পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছে।
প্রয়াত হলেন ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের প্রথম দিককার তারকা খেলোয়াড় মনোজ গুহ। তাঁর প্রয়াণের জন্য বয়স জনিত কারণ রয়েছে বলেই পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছে। সতেরো থেকে আঠারো বছর আগে মাইল্ড স্ট্রোকে শরীরের একটা দিকে আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হলেও হাঁটা-চলা বা স্বাভাবিক জীবন-যাপনে কোনও অসুবিধা অনুভব করেননি মনোজ গুহ। কিন্তু দিন সাতেক আগে থেকে তিনি অসুস্থ বোধ করেন। সোমবার ভোর ১.৪৫টায় তিনি প্রয়াত হন। সোমবার সকালেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় তাঁর।
১৯২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে জন্ম মনোজ গুহর। একাধারে তিনি যেমন ছিলেন ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার তেমনি ছিলেন ফুটবলার। খেলাধূলোর সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪৫ সালে তিনি অমৃত বাজারের চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে সেখান থেকেই অবসর নিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে অমৃত বাজারে কাজ করতেন বিখ্যাত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব সুনীল বোস। মনোজ গুহর সঙ্গে অমৃত বাজার পত্রিকাতেই সে সময় ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতেন অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্যরাও। বলতে গেলে কর্মক্ষেত্রে বরাবর একদল ক্রীড়া ব্যক্তি ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের সাহচর্যও পেয়ে এসেছিলেন তিনি।
ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার হিসাবে মনোজ গুহ দেশ ও আন্তর্জাতিকস্তরে খ্য়াতি পেলেও মনোজ গুহর প্রথম ভালোবাসা ছিল ফুটবল। কলকাতার ফুটবল ময়দানের দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব ইয়ং বেঙ্গলের হয়ে তিনি ফুটবল খেলতেন। পরে তিনি আইএফএ লিগের প্রথম ডিভিশনের ক্লাব এরিয়ান ও ভবানীপুরের হয়েও ফুটবল খেলেন। ১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের রেফারি পরীক্ষাতেও পাস করেছিলেন। ফুটবল খেলা, মাঠে রেফারির ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার হিসাবে আন্তর্জাতিকস্তরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।
১৯৫০ সালে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে আরও এক বিখ্যাত নাম ছিল নান্দু নাটেকর। বলতে গেলে নান্দু নাটেকরের পাশে নিজেকে দেশের অন্যতম সেরা শাটলার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মনোজ গুহ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত সিঙ্গলসে দেশের তিন নম্বর ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার ছিলেন মনোজ গুহ। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত তিনি ক্রমতালিকায় ছিলেন চার নম্বরে। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় ব্যাডমিন্টন দল প্রথম বিদেশে খেলতে যায়। শ্রীলঙ্কা যাওয়া সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলার মনোজ গুহ। ১৯৫১-৫২ সালে আমেরিকায় হওয়া টমাস কাপে ভারতের যে ব্যাডমিন্টন দল জোনাল ফাইনাল খেলে তারও সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৫৪-৫৫ সালেও ডেনমার্কেও জোনাল ফাইনালে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সে সময় বিশ্ব ব্য়াডমিন্টন শক্তিতে ভারত যে তৃতীয় শক্তি হিসাবে উঠে এসেছিল তার জন্য মনোজ গুহর অবদান কোনও অংশে কম ছিল না।
বিশ্ব ব্যাডমিন্টনের ডাবলসে গজানন হেমাড্ডির সঙ্গে জুটি বেধে মনোজ গুহ বিশ্ব ক্রমতালিকায় ৪ নম্বর স্থানে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু, আমরা ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের স্বর্ণযুগ বলতে শুধু প্রকাশ পাড়ুকন বা সাইনা নেওয়াল, পিভি সিন্ধু, শ্রীকান্ত বা প্রণয়দের সময়কেই বুঝে থাকি। কিন্তু, স্বাধীনতার সময় থেকেই যে ভারতীয় শাটলাররা ইউরোপের শাটলারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্ব সেরার মঞ্চে অন্যতম সেরা শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়িছিলেন তার খবর ক'জনের জানা রয়েছে।
ক্রীড়াবিদ হিসাবে মনোজ গুহর সবচেয়ে বড় কীর্তি ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে নয়া প্রজান্মকে প্রতিষ্ঠা করা। আশির দশকে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে এক নবীন প্রজন্মের জোয়ার দেখা গিয়েছিল তার জনক ছিলেন মনোজ গুহ। তার হাত ধরে সে সময় কলকাতার বুক থেকে উঠে এসেছিলেন একাধিক শাটলার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম অমৃতা মুখোপাধ্যায়, সৌমেন ভট্টাচার্য। এমনকী খোদ মনোজ গুহর ছেলে শশাঙ্ক শেখর গুহ যিনি লাল্টু গুহ নামেই ব্যাডমিন্টন মহলে পরিচিত ছিলেন, তিনি এই নবীন প্রজন্মের তালিকায় ছিলেন। এমন বহু শাটলার সে সময় জাতীয় স্তরে বাংলা থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
ভারতের ব্যাডমিন্টনের ইতিহাস ঘাটলে যেটা জানা যায়, পুণেতে এই খেলা প্রথম চালু করেছিল ইংরাজরা। মূলত বডি ফিটনেস-এর জন্য এবং ইন্ডোরে খেলার সুবিধার জন্য ইংরাজরা এটাকে চালু করেছিল। কারণ পরিবারের স্ত্রীরাও এতে সহজে অংশ নিতে পারতেন। এভাবেই আস্তে আস্তে ব্যাডমিন্টন খেলা ভারতে ছড়ায়। আর প্রতিযোগিতামূলক ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের প্রথম প্রজন্মের প্লেয়ার ছিলেন মনোজ গুহরা। কিন্তু, সঠিক উৎসাহ এবং পরিকাঠামোর অভাবে ভারত আস্তে আস্তে বিশ্ব ব্যাডমিন্টনের আঙিনায় পিছু হঠতে থাকে।
মনোজ গুহ বুঝতে পেরেছিলেন ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে অপেশাদারী মনোভাবের পরিস্থিতিকে। প্রতিযোগিতামূলক ব্যাডমিন্টনে টিকে থাকতে হলে যে তরুণ রক্ত লাগবে তাও নিজের ক্রীড়া দক্ষতায় টের পেয়েছিলেন তিনি। ৮০ দশকে তাই কলকাতার উপকন্ঠে বাঘাযতীনের কাছে কুসুম কাননের অরুণোদয় সংঘের মাঠে তৈরি করেছিলেন ব্যাডমিন্টন অ্যাকাডেমি। যেখান থেকে একের পর এক জাতীয় সেরা প্লেয়ার তুলে এনেছিলেন। বলতে গেলে বাংলার ব্যাডমিন্টনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কারিগর ছিলেন তিনি। তাই বাংলার ব্যাডমিন্টন জগতে তিনি আজও এক বিপ্লবী। এমন এক ক্রীড়াবিদের কথা আমরা সকলেই ভুলে গিয়েছিলাম। তাঁর প্রয়াণের খবর না পেলে হয়তো আড়ালেই পড়ে থাকত ভারতের এক কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদের কৃতিত্বের কথা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে দেশের নাম উজ্জ্বল করার পিছনে এক বাঙালির হাত ছিল তা বর্তমান প্রজন্মের ক'জন জানে!