সামনে ১ লক্ষ ২০ হাজার দর্শক ও মোহনবাগান, ভাইচুং-কে কোন টনিক দিয়েছিলেন পিকে
সামনে ১ লক্ষ ২০ হাজার দর্শক ও মোহনবাগান, ভাইচুং-কে কোন টনিক দিয়েছিলেন পিকে
এমন ম্যাচ হয়তো আগে কখনও দেখেনি কলকাতা। হয়তো না দেখবে। এক লক্ষ কুড়ি হাজার মানুষে উপচে পড়া যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের হাই-ভোল্টেজ ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে লড়াই শুরু হয়েছিল মাঠের বাইরে। প্রতিপক্ষের উদ্দেশে একের পর এক শ্লেষাত্মাক উক্তি করে ম্যাচের পারদ কার্যত একাই তুঙ্গে তুলে দিয়েছিলেন মোহনবাগানের কোচ, প্রয়াত অমল দত্ত। নাইজেরিয় স্ট্রাইকার চিমা ওকেরি ও পঞ্চাশের দশকে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা 'ডায়মন্ড সিস্টেম' ছিল তাঁর হাতিয়ার।
অন্যদিকে, ইস্টবেঙ্গলের কোচ প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাচের আগে একটিও শব্দ খরচ করেননি। উল্টে তিনি ভাইচুং ভুটিয়া, নাজিমুল হক সম্বলিত তরুণ ব্রিগেডকে আগলে হাসিমুখেই মাঠে প্রবেশ করেছিলেন। যুবভারতীয় একলাখি গর্জন সামলে ম্যাচে শেষ হাসিও হেসেছিলেন সেই পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের ফুটবলারদের তিনি সেদিন কোন টনিক দিয়েছিলেন, জানিয়েছেন সেই জয়ের অন্যতম নায়ক ভাইচুং ভুটিয়া।
ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান
১৩ জুলাই ১৯৯৭। ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান। কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। ম্যাচ শুরুর আগে মোহনবাগানের কোচ প্রয়াত অমল দত্ত প্রতিপক্ষ শিবিরের ওপর চাপ বাড়াতে, ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার ও কোচের উদ্দেশে শ্লেষাত্মক উক্তি করতে শুরু করেছিলেন। তাতেই পরিস্থিতি কার্যত তেঁতে উঠেছিল। ম্যাচ দেখতে মাঠে ভিড় জমিয়েছিলেন ১ লক্ষ ২০ হাজার দর্শক। এযাবৎকালে কলকাতার কোনও ফুটবল ম্যাচে এমন ভিড় আর চোখে পড়েনি।
ইস্টবেঙ্গলের জয়
এক লাখি দর্শকের গর্জনে রেফারি যে কখন ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজিয়েছিলেন, তা টেরই পাওয়া যায়নি। তার মধ্যে শুরুতেই বেশ কয়েকবার ঝটিতি আক্রমণে উঠে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলেন চিমা ওকেরিরা। সাইড লাইনে বসা লাল-হলুদের কোচ পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে তখনও হাসি লেগেছিল। তা দেখে ফেলেছিলেন দলের ফুটবলাররা। অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আচমকাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তরুণ নাজিমুল হক। ম্যাচের ২৫ মিনিটে দুর্দান্ত গোল দিয়ে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধের ৪৬, ৮৫ ও ৮৮ মিনিটে গোল দিয়ে নিজের হ্যাটট্রিক ও দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন ইস্টবেঙ্গল স্ট্রাইকার ভাইচুং ভুটিয়া। বাই-সাইকেল কিকে চিমা ওকেরি এক গোল শোধ দিলেও মোহনবাগানকে জয়ের সরণীতে ফেরাতে পারেননি।
নতুন তারকার উত্থান
ওই ম্যাচেই এক নতুন তারকার উত্থান দেখেছিল ভারতীয় ফুটবল। বড় ম্যাচে হ্যাটট্রিক করা সেদিনের সেই তরুণ ভাইচুং ভুটিয়া অচিরেই পাহাড়ি বিছের আখ্যা পান। পরে তাঁর নেতৃত্বেই ভারতীয় দলের সাফল্য এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছয়। তাঁর কেরিয়ারের শুরুটা হয়তো এমন হতো না, যদি না তিনি পিতৃসম পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠতেন। এ কথা নিজেই স্বীকার করেছেন দেশের ফুটবল লেজেন্ড।
কী বললেন ভাইচুং
লেজেন্ড পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণে গভীরভাবে শোকাহত ভাইচুং ভুটিয়া সেই ইস্ট-মোহন ম্যাচের কথা স্মরণ করেছেন। বলেছেন যে কীভাবে মোহনবাগানের কোচ, প্রয়াত অমল দত্ত তাঁদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কিংবদন্তি পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় সেসব নিজে গিলে দলের ফুটবলারদের অক্ষত রেখেছিলেন বলেও জানিয়েছেন ভাইচুং। সদা হাস্যময় প্রদীপ কুমারের 'ভোকাল টনিক'ই সেদিন অমল দত্তের 'ডায়মন্ড সিস্টেম'কে হারিয়ে দিয়েছিল বলে মনে করেন পাহাড়ি বিছে। ভাইচুং বলেছেন, ম্যাচের আগেও দলের ফুটবলারদের মজাদার কথা বলে চাপমুক্ত করেছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়।
গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক
কেবল মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও দলের ফুটবলারদের সঙ্গে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্দান্ত সম্পর্ক ছিল বলে জানিয়েছেন ভাইচুং ভুটিয়া। বলেছেন, অনুশীলন শেষে কখনও কখনও ফুটবলারদের নিজের বাড়িতে ডেকে সুস্বাদু খাবার খাওয়াতেন কোচ পিকে। এহেন কিংবদন্তির অধীনে খেলতে পেরে তিনি ধন্য বলে জানিয়েছেন ভাইচুং ভুটিয়া।