ভারতের কাছে কচুকাটা হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজও বিদায় নিল বিশ্বকাপ থেকে: তাঁদের ব্যর্থতার ৭টি কারণ
বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতের কাছে ১২৫ রানে চূর্ণ হয়ে এবারের মতো বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল আরেক প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতের কাছে ১২৫ রানে চূর্ণ হয়ে এবারের মতো বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল আরেক প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভারতকে এক সময়ে চাপে রেখেও তাদের ২৬৮ রান করতে দেন ক্যারিবিয়ান বোলাররা এবং তারপরে চূড়ান্ত ব্যাটিং বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গুটিয়ে যায় মাত্র ১৪৩ রানে। ছিয়ানব্বইয়ের পর টানা এই নিয়ে ছ'টি বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে পৌঁছতে ব্যর্থ হলেন ক্যারিবিয়ানরা।
অথচ শুরুটা দারুন করেছিল জেসন হোল্ডারের দল। টরেন্ট ব্রিজে প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে মাত্র ১০৫ রানে অল আউট করে ৭ উইকেটে যেতে তারা। বলা হয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবারের কালো ঘোড়া। দলে একরাশ মারকাটারি ব্যাটসম্যান নিয়ে এবারে বিশ্বকাপে চমক দেখাতে এসেছে তারা। কিন্তু তার পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে বাগে পেয়েও মাত্র ১৫ রানে হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং পর পর হারতেই থাকে। সাত ম্যাচের শেষে তাদের পয়েন্ট সাকুল্যে তিন (একটি জয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে বৃষ্টির দরুন পয়েন্ট ভাগাভাগি) এবং আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পরে তৃতীয় দল হিসেবে পঁচাত্তর এবং ঊন-আশির চ্যাম্পিয়নদের পত্রপাঠ বিদায়।
কিন্তু এত প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের এমন ল্যাজেগোবরে অবস্থা কেন হল? ক্রিস গেল, আন্দ্রে রাসেল, কার্লোস ব্রাথওয়েইট, হোল্ডারদের মতো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান থাকতেও এই বিপর্যয়ের কারণ কী?
-
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
--
-দলে ফ্রিল্যান্স ক্রিকেটারের ছড়াছড়ি; টিম স্পিরিটের অভাব
সর্বপ্রথম কারণ দলে একাধিক 'ফ্রিল্যান্স ক্রিকেটার'। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়রা তাঁদের ব্যক্তিগত রেকর্ডের জন্যে বিখ্যাত। এই গ্রহের নানা প্রান্তে বিভিন্ন টি২০ লিগ ক্রিকেটে তাঁরা বছরভর মাতিয়ে রাখেন কিন্তু দেশের হয়ে একজোট হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা তাঁদের নিতান্তই কম। ফলে, দলের মধ্যে সেভাবে গাঁথুনি তৈরী হয়নি। যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলিতে 'নিজের খেলা' খেলতে গিয়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে এসেছেন ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানরা, তাতে এটা পরিষ্কার যে টিম ওয়ার্ক এবং টিম প্ল্যানের ধার তাঁরা বিশেষ ধারেন না। তাহলে কি বলতে হয় যে অর্থকেন্দ্রিক ক্রিকেট ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্তমান খেলোয়াড়দের খেলাটির প্রতি বিশেষ আনুগত্য নেই? এতদিন তাদের বোর্ডের নেতৃত্বকে দোষারোপ করা হচ্ছিল; কিন্তু সেখানে কিছুদিন আগেই বদল এসেছে। তার পরেও এই ফল?
কিছু করে দেখানোর জেদ চোখে পড়ল না
দ্বিতীয়ত, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এবারে দেখে মনে হয়নি যে তাঁদের মধ্যে কিছু করে দেখানোর জেদ রয়েছে। দলে একাধিক তরুণ ক্রিকেটার আছে দলটিতে। বিশ্বকাপের চাপ তাঁরা নিতে পারলেন না, নাকি ঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে পারলেন না, তা বিশ্লেষণের বিষয়। কিন্তু সব মিলিয়ে, পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম ম্যাচটি ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজকে কখনওই লম্বা রেসের ঘোড়া মনে হয়নি। এক দু'জন চেষ্টা চরিত্র করেছেন, এই যা। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জেতার জায়গা থেকে ক্যারিবিয়ানরা সোনার সুযোগ হেলায় হারান; হারেন যথাক্রমে ১৫ এবং পাঁচ রানে। ইংল্যান্ডের সঙ্গেও ১৪৪ রানে ৩ থেকে তাঁরা ধসে পরে মাত্র ২১২ রানে শেষ হয়ে যান। একই চিত্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও দেখা যায় যেখানে ২৪২ রানে ৩ থেকেও শেষ দশ ওভারে বিরাট স্কোর খাড়া করতে ব্যর্থ হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা রান পাননি
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং-এর টপ অর্ডারের যৌথ গড় এবারের বিশ্বকাপে ছিল মাত্র ৩৪.২৬, যা শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তানের থেকে ভালো। তাঁদের টপ অর্ডারের কোনও ব্যাটসম্যান শতরান করতে পারেননি (ব্রাথওয়েইট সেঞ্চুরি করেন ছয় নম্বরে)। ক্রিস গেলও তাঁর পর্যায়ে বলতে গেলে ব্যর্থই। আটটি অর্ধ শতরান করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের উপরের দিকের ব্যাটসম্যানরা যা বোঝায় তাঁরা বড় ইনিংস খেলতে ডাহা ফেল এবং তার ফল পেয়েছে দল।
ব্যাটসম্যানরা পার্টনারশিপ গড়তে ব্যর্থ
পার্টনারশিপ গড়তেও এবারে ব্যর্থ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সারা প্রতিযোগিতায় মাত্র দু'টি একশো রানের এবং পাঁচটি পৌঁছার রানের পার্টনারশিপ করতে পেরেছে তাদের ব্যাটসম্যানরা যা সোজাসুজি আঙ্গুল দেখিয়ে দেয় দলগত পারফরম্যান্স কতটা পিছিয়ে রয়েছেন তাদের তাবড় ব্যাটধারীরা।
অতি সাধারণ মানের বোলিং
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিংও ছিল এবারে কদর্য। ক্যারিবিয়ান বোলারদের গড় ছিল এবারে সাঁইত্রিশ-এরও বেশি যা টুর্নামেন্টের তৃতীয় জঘন্যতম। এ ব্যাপারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে নিচে রয়েছে শুধুমাত্র আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ। স্ট্রাইক রেটের ব্যাপারেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের অবস্থা ছিল তথৈবচ। প্রায় সাঁইত্রিশ স্ট্রাইক রেট এবং ছয়ের উপরে ইকোনোমি রেট দিয়ে আর যাই হোক, বিশ্বকাপের মতো প্রতিযোগিতায় যে জেতা যায় না, তা ওয়েস্ট ইন্ডিজের অতি বড় সমর্থকও অস্বীকার করতে পারবে না। একাধিক প্রতিশ্রুতিমান বোলার তাদের দলে থাকলেও শেলডন কোটরেল ছাড়া একজনও ১০টি উইকেট পাননি এবারের বিশ্বকাপে এবং সবার গড় ত্রিশ-এর বেশি। একমাত্র পাকিস্তানের সঙ্গে ছাড়া আর কোনও ম্যাচে এ যাবৎ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং বিপক্ষকে বিশেষ বেগ দিতে পেরেছে।
আন্দ্রে রাসেল জ্বলে উঠতেই পারলেন না দরকারের সময়ে
পাশাপাশি, তাদের কিছু সেরা খেলোয়াড় যাঁদের উপরে ভরসা করা গিয়েছিল তাঁরা জ্বলে উঠতে ব্যর্থ। আন্দ্রে রাসেল তাঁদের অন্যতম। আইপিএল-এ তাঁর মারকাটারি রূপ দেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমর্থকরা আশান্বিত ছিলেন যে ওই একই খেল তিনি বিশ্বকাপেও দেখাবেন কিন্তু তা বাস্তবে দেখা গেল কই? ব্যাটে বলে বিষেশ কিছুই করতে না পেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই বিধ্বংসী অল-রাউন্ডার শেষ পর্যন্ত হাঁটুর চোট নিয়ে প্রতিযোগিতারই বাইরে চলে গেলেন।
এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ টি২০-র দল বড়জোর
শেষ কথায়, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ খুব টেনেটুনে টি২০-র দলের বেশি কিছু নয়। যেহেতু তাদের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই এখন টি২০ খেলেন এবং ওই ফরম্যাটে রীতিমতো স্পেশ্যালিস্ট (ওয়েস্ট ইন্ডিজের এখন দু'বারের টি২০ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন), তাই তাঁদের ৫০ ওভার টিকে থেকে ম্যাচ বের করার মানসিকতার যথেষ্ট অভাব। আর শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বকাপে তাঁদের মুখ থুবড়ে পড়ার এটাও বড় কারণ।